ছট পূজা কি এবং কেন পালিত হয়
ছট পূজা হল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব, যা সূর্যদেব এবং ছট মাইয়াকে উৎসর্গ করে পালিত হয়। এটি মূলত বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, নেপাল এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চল ও বাংলাদেশে কিছু জায়গায় বিশেষভাবে পালিত হয়। ছট পূজা কেন পালিত হয়? ছট পূজার মূল লক্ষ্য হল সূর্যদেব ও ছট মাইয়ার কৃপা প্রার্থনা করা, যাতে জীবন সুখ-সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয়। বিশ্বাস করা হয় যে সূর্যদেব মানবজাতির স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং কল্যাণের রক্ষক।
![]() |
ছট পূজা |
ছটপূজার বিস্তারিত নিচে আলোচনা করা হয়েছে।
ছট পুজা:-ছট পূজা কত তারিখে হবে?
কালীপূজা তথা দীপাবলির ঠিক ছয় (৬) দিন পর পালিত হয় যে উৎসব তাই ছট পূজা নামে পরিচিত। বাংলা কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই পুজোর বিধান রয়েছে। অথর্ব বেদেও এই পর্বের উল্লেখ রয়েছে। ছট পর্ব সম্পর্কে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। মনে করা হয়, মহাভারতে কুন্তি দ্বারা সূর্যের আরাধনা এবং কর্ণের জন্ম থেকেই এই পর্বের সূচনা। আবার ছট পর্ব শুরুর অন্য একটি কাহিনীও প্রচলিত আছে। পুরাণে কথিত আছে, প্রিয়ব্রত নামক রাজার কোনও সন্তান ছিল না। সন্তানপ্রাপ্তির জন্য তাঁকে পুত্রয়েষ্টি যজ্ঞ করতে বলেন মহর্ষি কাশ্যপ। যজ্ঞের ফলস্বরুপ রানির একটি ছেলে হয়, কিন্তু সে মৃত জন্ম নেয়। সে সময়ই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। আকাশ থেকে এক বিমান অবতীর্ণ হয় এবং সেখানে আসীন দেবী বলেন, 'আমি ষষ্ঠ দেবী, আমি বিশ্বের সমস্ত শিশুর রক্ষা করি।' শিশুর মৃত শরীর স্পর্শ করেন এবং ওই শিশু বেঁচে ওঠে। এর পরই রাজ্যে এই ব্রত করার নির্দেশ দেন রাজা। এ-ও মনে করা হয়, ছট দেবী সূর্যের বোন। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যই সূর্যের আরাধনা করা হয়। এ ছাড়াও মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে জানান যায়, সৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী প্রকৃতি দেবী নিজেক ছ-ভাগে ভাগ করেছিলেন। তাঁর ষষ্ঠ অংশ সর্বশ্রেষ্ঠ মাতৃদেবী রূপে পরিচিত। তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্রী এবং সন্তানদের রক্ষা করেন। পুরাণে এই দেবীর নামই কাত্যায়েনি, যাঁর নবরাত্রের ষষ্ঠী তিথিতে পুজো হয়। আবার পুরাণে এ-ও উল্লেখ আছে, কার্তিক শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠীতে সূর্যাস্ত এবং সপ্তমীতে সূর্যোদয়ের মধ্যে বেদমাতা গায়েত্রীর জন্ম হয়। প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ থেকে উত্পন্ন শিশুদের রক্ষা করে থাকেন তিনি। তিনি বিষ্ণু দ্বারা রচিত মায়া। শিশু জন্মের ষষ্ঠ দিনে ষষ্ঠী দেবীর পুজো করা হয়। যাতে শিশুর কখনও কোনও প্রকার দুঃখ-কষ্ট না হয়। আবার এ-ও মনে করা হয়, পাণ্ডব যখন পাশা খেলায় নিজের সমস্ত রাজপাট হারিয়ে ফেলে তখন দ্রৌপদী ছট ব্রত করেন। দ্রৌপদীর মনোস্কামনা পুরো হয় এবং পাণ্ডব তাঁদের রাজপাট ফিরে পান। এ ছাড়া রামায়ণেও ছট পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন কালে বিহার এবং উত্তর প্রদেশে এই পর্ব অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু এখন এই প্রান্তের মানুষ যেখানেই খাকেন, সেখানেই এই পুজো হয়। এই ব্রতে তিন দিনের কঠোর উপবাসের বিধান রয়েছে। যাঁরা এই ব্রত করেন, তাঁদের পঞ্চমীর দিন নুন ছাড়া ভোজন গ্রহণ করেত হয়। ষষ্ঠীতে নির্জলা থেকে ব্রত করতে হয়। ষষ্ঠীতে অস্ত সূর্যের পুজো করে অর্ঘ্য নিবেদন করতে হয়। সপ্তমীর সকালে উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য দিতে হয়। তার পর জল খেয়ে উপবাস পুরো করতে হয়। কোনও নদী বা পুকুরে গিয়ে এই পুজো করতে হয়। মনে করা হয়, পঞ্চমীর রাত্রি থেকেই ঘরে ঘরে ষষ্ঠীর আগমন হয়। সূর্যের এই ব্রতে শক্তি এবং ব্রহ্মার উভয়ের পুজোর ফল পাওয়া যায়। তাই এই ব্রত সূর্যষষ্ঠীর নামে বিখ্যাত। চতুর্থীর দিন থেকে এই ব্রত শুরু। এদিন পুরো দিনের উপবাস রাখা হয়। রাতে কাঠ বা মাটির উনুনে পায়েস এবং লুচি রান্না করা হয়। ভোগ লাগিয়ে সেই প্রসাদ খান মহিলারা। তৃতীয় দিন প্রথম অর্ঘ্য এবং চতুর্থ দিন দ্বিতীয় অর্ঘ্য। এই দুই দিনই কোনও জলাশয়ে গিয়ে অস্ত সূর্য এবং উদিত সূর্যের আরাধনা করে সূর্যকে অর্ঘ্য দিতে হয়। এই ব্রতের বিশেষত্ব হল, বাড়ির যে কোনও সদস্য এই ব্রত করতে পারে। ছট পুজোর সময়ে বাড়ি স্বচ্ছ রাখা হয়। এই ব্রতের বিশেষ প্রসাদ ঠেকুয়া।
পূজার প্রধান বৈশিষ্ট্য ও প্রক্রিয়া
ছট পূজা সাধারণত চার দিনব্যাপী পালিত হয় এবং কঠোর ব্রত, শুদ্ধতা ও নিরামিষ আহার এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১. নহায় খায় (প্রথম দিন): ব্রতধারীরা নদী বা জলাশয়ে স্নান করে নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন।
২. লোহান্ডা বা খরনা (দ্বিতীয় দিন): উপবাস শুরু হয় এবং সন্ধ্যায় গুড় ও চালের খিচুড়ি, দুধ, কলা ইত্যাদি প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
3. সন্ধ্যা অর্ঘ্য (তৃতীয় দিন): উপবাস পালনকারী ব্যক্তি নদী বা জলাশয়ের ধারে গিয়ে সূর্যাস্তের সময় সূর্যদেবকে অর্ঘ্য প্রদান করেন।
4. উষা অর্ঘ্য (চতুর্থ দিন): ভোরবেলা উদীয়মান সূর্যকে অর্ঘ্য প্রদান করে ব্রত সম্পন্ন করা হয়।
ছট পূজার মাহাত্ম্য কি
১)ছট পূজাকে স্বাস্থ্য ও মনোবল বৃদ্ধির উপাসনা হিসেবে দেখা হয়।
২)এটি পারিবারিক সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য করা হয়।
৩)কৃষিভিত্তিক সমাজে এটি সূর্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি উপায়।
ছট পূজার অন্যতম বিশেষত্ব হল এতে কোনো পুরোহিতের ভূমিকা প্রয়োজন হয় না; সাধারণ মানুষই এই ব্রত পালন করেন। এটি হিন্দু ধর্মের অন্যতম কঠোর ও গুরুত্বপূর্ণ উপবাস ও উপাসনার উৎসব।
Comments
Post a Comment