আরতি কি এবং কেন করবেন? সহজ ধাপে আরতি করার পদ্ধতি

আরতি কি?

"আরতি" সাধারণত হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেবতা বা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভক্তিমূলক সঙ্গীত বা স্তুতি বোঝায়। এটি প্রার্থনার একটি বিশেষ রূপ, যেখানে প্রদীপ বা দীপ জ্বালিয়ে দেবতার সামনে নাচানো হয়, সাথে ভক্তিগীতি গাওয়া হয়। আরতি ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যম। সাধারণত একটি থালায় বা দীপস্তম্ভে (আরতি ডিশ) ঘি বা তেলের প্রদীপ, ফুল, ধূপ ইত্যাদি রাখা হয় এবং তা দেবতার সামনে বৃত্তাকারে ঘোরানো হয়। বিভিন্ন দেবদেবীর জন্য আলাদা আরতি গান রয়েছে, যেমন—"জয় গণেশ দেবা" (গণেশের আরতি), "ওম জয় জগদীশ হরে" (বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরতি) ইত্যাদি আরতি গান।আরাত্রিকের আরেক নাম 'নীরাজন', যা সাধারণ ভাষায় 'আরতি' হিসেবে পরিচিত। দেবদেবীর আরতি করলে, পূজার মধ্যে যে কোনো ত্রুটি থাকলে তা দূর হয় এবং পূজা সফল হয়।
আরতি কি এবং কেন করবেন?
আরতি কি এবং কেন করবেন? 

আরতি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আরতির মাহাত্ম্য/মহিমা প্রসঙ্গে শাস্ত্রে আছে:-
" মন্ত্রহীনং ক্রিয়াহীনং যৎকৃতং পূজনং হরেঃ।
সর্বং সম্পূর্ণতামেতি কৃতে নীরাজনে শিবে।।"
(হরিভক্তিবিলাস)
 অর্থাৎ দেবদেবীর আরতি করলে, মন্ত্র বা ক্রিয়াবিহীন পূজা হলেও তা ফলপ্রসূ হয়। যে ব্যক্তি নীরাজন দ্বারা শ্রীভগবানের পূজা করেন, তিনি ইহলোক এবং পরলোক উভয়েই মুক্তি লাভ করেন। যে ব্যক্তি শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণকারী ভগবান বিষ্ণুকে ভক্তির সাথে দর্শন করেন, তিনি পরম পদ লাভ করেন,আচমন, প্রাণায়াম, বিভিন্ন প্রকার শুদ্ধি এবং ন্যাসাদি যে-অর্থে পূজার অঙ্গীভূত অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠান, আরতি ঠিক সেই অর্থে পূজাঙ্গীভূত অবশ্য করণীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে পড়ে না কিন্তু আরতি  একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাংকেতিক/প্রতীকী পূজার  মধ্যে পড়ে । 


ভারত / বাংলাদেশের মন্দিরের আরতি  এবং তার সময় সূচি। 
1.মঙ্গল আরতি – সকাল-04:30AM-থেকে সকাল-06:300 AM
2. শৃঙ্গার  আরতি – সকাল-07:15AM-থেকে সকাল-0830 AM 
3.পুষ্প আরতি –সকাল- 08:30AM-থেকে সকাল-09:300 AM 
4.ভোগ আরতি- দুপুর-1200 PM-থেকে  দুপুর-12.59 PM 
5.উত্থাপন  আরতি .বিকাল-04:00 PM-থেকে বিকাল-04.30 PM
6.সন্ধ্যা আরতি – সন্ধ্যা-06:O0PM-থেকে সন্ধ্যা-0700 PM 
7.শয়ন আরতি – রাত্রি-08:00 PM-থেকে রাত্রি-0830 PM
গৃহস্থের আরতি  কখন করা হয় / আরতি করার সময় -

 ১.সমস্ত দেব দেবীর পূজার শেষে। 
 ২.সন্ধ্যায় সন্ধ্যা  আরতি- সূর্য অস্ত যাবার পরে /সাধারণত আকাশে তারা দেখা দেওয়ার পর সন্ধ্যা  আরতি।
★সমস্ত সনাতন ধর্মালম্বী (হিন্দু ধর্মালম্বী ) গৃহস্থের বাড়িতে সকালে সূর্য উদয়ের আগে মঙ্গল  আরতি করণীয়,কিন্তু গৃহস্থের বাড়িতে সাধারণত প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যা আরতিই করা হয়,সকালের   মঙ্গল  আরতি করা হয় না।

সন্ধ্যা আরতি
ভগবান শ্রী হরির ইচ্ছায় ব্রহ্মদেব দেবী সন্ধ্যা কে সৃষ্টি করেন। দেবী সন্ধ্যা ছিলেন  এক মহান তপস্বী । এই সন্ধ্যাই হলেন  প্রথম বৈদিক  নারী ,যিনি  মানব কল্যাণের জন্য ভগবান শ্রী হরির কাছে বর প্রার্থনা করেছিলেন । ওনার নামে নামকরণ করা হয় : প্রাত  সন্ধ্যা এবং সায়ং  সন্ধ্যা । 
আরতি করার নিয়ম।প্রথমে ঘৃতের দীপমালা (আরতির জন্য প্রদীপ) জ্বালিয়ে, তারপর জলপূর্ণ শঙ্খ, বিশুদ্ধ বস্ত্র, এবং আম্রপল্লব বা অশত্থপল্লব ইত্যাদি ব্যবহার করে, শেষে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম দিয়ে নীরাজন করা হয়। তবে, পল্লবাদির পরিবর্তে বিল্বপত্র, পুষ্প, কর্পূর-দীপ, ধূপাদি এবং চামর দিয়েও আরতি করা যেতে পারে, যা বিধিসম্মত। আরতি করার নিয়ম হলো, প্রথমে দীপমালা প্রজ্জ্বলিত করে সেটি সম্মুখে একটি ত্রিকোণ মন্ডলে স্থাপন করতে হয়। এরপর অর্চনার মাধ্যমে দেবতাকে নিবেদন করা হয়। দীপমালা অবশ্যই বিষম সংখ্যায় হতে হবে, যেমন এক, তিন, পাঁচ ইত্যাদি। দীপমালা অর্চনা বা নিবেদন করার পর, দীপটি ডান হাতে তুলে, বাঁ হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মূলমন্ত্র বা দেবতার স্তোত্র পাঠ করে আরতি করতে হয়।

আরতিতে ধূপের ব্যবহার
প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে ঘরে ধূপ ও ধুনো জ্বালানোর প্রথা প্রচলিত। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, ধূপকাঠি জ্বালানো বাড়িতে ইতিবাচক শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং এটি পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটি শুভ পরিবেশ সৃষ্টি করে। সনাতন ধর্মে বলা হয় যে বাঁশের কাঠি জ্বালানো পরিবারে অকল্যাণ ডেকে আনে। তাই আরতিতে বাঁশ কাঠি দিয়ে তৈরি ধূপ না জ্বালিয়ে, বাঁশবিহীন ধুপ বা ধুনো ব্যবহার করা উচিত।

দীপো জ্যোতি পরং ব্রহ্ম দীপো জ্যোতির্জনার্দনঃ।
দীপো হরতু মে পাপং সন্ধ্যাদীপ নমোস্তুতে।

প্রদীপ/দীপমালা ঘোরাবার   বিধি:- 
প্রদীপ (দিয়া)অথবা দীপমালা(জ্বলন্ত প্রদীপের পঙ্কতি ,যেমন পঞ্চপ্রদীপ) দেবতার শ্রীচরণে চারবার, নাভিদেশে দুইবার, মুখমন্ডলে একবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার ঘোরাতে হয়।

সন্ধ্যা মন্ত্র - দীপো জ্যোতি পরং ব্রহ্ম দীপো জ্যোতির্জনার্দনঃ। 
দীপো হরতু মে পাপং সন্ধ্যাদীপ নমোস্তুতে।

আরতি বা আরাত্রিক হলো পূজার কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাচার, যেমন প্রদীপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, বস্ত্র, পুষ্প এবং চামর। আরতির দীপ, শঙ্খে থাকা জল, পুষ্প ইত্যাদি পঞ্চভূতের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এরা প্রপঞ্চ (মায়া বা অলীক) এরও প্রতীক, যেমন দীপ রূপের, শঙ্খের জল রসের, পুষ্পের গন্ধের, চামরের বাতাস বা স্পর্শের, এবং ঘণ্টাধ্বনি শব্দের প্রতীক। আরতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভক্ত এসব উপাদান দেবতাকে উৎসর্গ করে, নিজেকে ও তাঁর পায়ে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেন। মাঝে মাঝে শুধুমাত্র প্রদীপ দিয়েও আরতি করা হয়, তবে প্রদীপ দেবতার শ্রীচরণে চারবার, নাভিদেশে দুইবার, মুখমণ্ডলে একবার এবং সর্বাঙ্গে সাতবার ঘোরাতে হয়।


দীপো জ্যোতি পরং ব্রহ্ম দীপো জ্যোতির্জনার্দনঃ।
দীপো হরতু মে পাপং সন্ধ্যাদীপ নমোস্তুতে।

আরতি করার সময় এই ভুলগুলি এড়িয়ে চলুন

আরতি করার সময় কিছু সাধারণ ভুল হতে পারে যা আমাদের অভ্যেস বা অজ্ঞতার কারণে ঘটে। আরতি একটি পবিত্র আচার, এবং এটি সঠিকভাবে পালন করা উচিত। নিচে কিছু ভুলের কথা উল্লেখ করা হলো যা এড়িয়ে চলা উচিত:

অশুদ্ধ অবস্থায় আরতি না করা: আরতি শুরু করার আগে নিশ্চিত করুন যে আপনার হাত পবিত্র এবং আপনি পরিষ্কার অবস্থায় আছেন। অশুদ্ধ বা অপবিত্র অবস্থায় আরতি করলে সেই আরতি কার্যকরী হবে না বলে মনে করা হয়।

আরতির মোমবাতি বা দীপের সঠিক ব্যবহারে গাফিলতি: দীপ বা মোমবাতি সঠিকভাবে জ্বালানো এবং তা সঠিকভাবে আরতির পাত্রের সামনে রাখা উচিত। যদি এটি সঠিকভাবে না হয়, তবে তা আরতির গুরুত্ব কমিয়ে দেয়।

অবাধ্যতা ও অভব্যতা: আরতি করার সময় মনোযোগ দিন, যেন কোন ধরনের অবাধ্য বা অবিবেচক আচরণ না ঘটে। মনে রাখবেন যে, আরতি একটি গুরুতর আচার, যা নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করা উচিত।

অতি দ্রুত বা অতি ধীর গতিতে আরতি করা: আরতি খুব দ্রুত বা খুব ধীরে না করে, মনোযোগ দিয়ে সাধারণ গতিতে করতে হবে। এর ফলে পূজার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় থাকে এবং আচারটি সঠিকভাবে পালিত হয়।

অন্যদের কাছে শোরগোল বা বিরক্তি সৃষ্টি করা: আরতি করার সময় শোরগোল করা বা অন্যদের বিরক্ত করা উচিত নয়। এটি আধ্যাত্মিক পরিবেশের অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

আরতি শেষে দীপ বা মোমবাতি নষ্ট করা: আরতির পর দীপ বা মোমবাতি রেখে দেয়া উচিত। তা নষ্ট বা ঝুড়িতে ফেলা উচিত নয়, কারণ এটি পবিত্র আচারকে অপবিত্র করতে পারে।

আরতির সময় মন্ত্র উচ্চারণে ভুল: মন্ত্রের উচ্চারণ সঠিক হওয়া উচিত। ভুল উচ্চারণে মন্ত্রের ফলফলিতা কম হতে পারে। তাই মন্ত্রগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

এভাবে, আরতি করার সময় এই ভুলগুলো থেকে সাবধান থাকলে আচারটি পবিত্রভাবে এবং সঠিকভাবে পালিত হবে। এটি লক্ষ্যণীয় যে, যেভাবেই বা যেকোনো উপাচার দিয়ে আরতি করা হোক, দেবতার চরণে আত্মনিবেদনেই আরতির সমাপ্তি। অনেক সময় পূজার শেষে, আমরা যে ভগবানের পূজা করছি, তাঁর আরতি জানি না, তাই আমরা তাঁর আরতি করতে পারি না। সেই অবস্থায়, ভগবান নারায়ণের আরতি করা উচিত, কারণ তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্ম। আমরা যে কোনো ভগবানের পূজা করি না কেন, সব পূজা তাঁর কাছে পৌঁছায়।

অতি সংক্ষেপে গৃহস্থের সন্ধ্যা দেওয়ার নিয়ম হলো, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়ির প্রতিটি ঘরে রাখা ভগবানের ছবি বা মূর্তি, তুলসী গাছ, এবং গৃহদেবতাকে প্রদীপ দেখিয়ে প্রণাম করা। এরপর পৃথিবী, গোমাতা, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্রদেরও প্রদীপ দেখিয়ে প্রণাম করুন। তারপর লক্ষ্মী নারায়ণ, শিব, দুর্গা, গণেশ এবং দেবী সরস্বতীকে পাশাপাশি রেখে একে একে বারি, ধূপ ও প্রদীপ দেখান। শেষে, লোকাচার বা কুলাচার অনুযায়ী ঘণ্টা এবং শঙ্খ বাজিয়ে ভগবানদের প্রণাম করুন।

Comments