তুলসী মালা কত প্যাচ পরতে হয়
তুলসী মালা পরার কোনো নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক "প্যাচ" (ঘুরানো বা স্তর) সংখ্যা নেই, তবে সাধারণত ১, ৩, ৫, ৭ বা ১০ প্যাচে তুলসী মালা পরা হয়। এটি ভক্তের ভক্তি, নিয়ম ও বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে।
সাধারণভাবে দেখা যায়:
১ বা ৩ প্যাচ: সাধারণ ভক্তরা বা যারা সদ্য মন্ত্রজপ শুরু করেছেন, তারা ১ বা ৩ প্যাচ পরেন।
৫ বা ৭ প্যাচ: গভীর ভক্তি বা গুরু নির্দেশিত সন্ন্যাসীরা বা বৈষ্ণব ভক্তগণ পরেন।
১০ প্যাচ বা বেশি: খুবই নিষ্ঠাবান সাধক বা গুরু নির্দেশে বিশেষ কারণে কেউ কেউ পরতে পারেন।তুলসী মালা হিন্দু ধর্মে একটি পবিত্র মালা, যা তুলসী (Ocimum sanctum) গাছের কাঠ বা বীজ দিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত ভগবান কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা রাধার ভক্তরা ব্যবহার করেন জপ করার জন্য এবং গলায় ধারণ করেন। তুলসী মালার বিভিন্ন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে।
চলুন এখন আমরা জেনে নেই কি করে তুলসী মালা পরিধান করব..
স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে-যে ব্যক্তি নিজের গলায় তুলসী মালা ধারন করেনা, ওই মুঢ় ব্যক্তি যদি জল স্পর্শ করে তাহলে ঐ জল মদের(alcohol) সমান হয়ে যায় ও কেউ যদি খাবার স্পর্শ করে তাহলে সেই খাবার রাজহাঁসের মল/বিষ্টা সম হয়ে যায়।" তাই প্রত্যেক মানুষের তুলসী মালা পরিধান করা একান্ত কর্তব্য।
পদ্মপুরানে বলা হয়েছে,-যখন কোন মানুষ গলায় তুলসী মালা ধারণ করে স্নান করে তখন ওই তুলসীকে স্পর্শ করে জল সর্বাঙ্গে স্নাত হয়, ঐ ব্যক্তির এই পৃথিবীর সর্ব তীর্থ স্নানের পূণ্যফল প্রাপ্তি হয়ে যায়।" শ্রীল ব্যাসদেব পদ্মপুরানে এই সত্য লিখেছেন এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারেনা।
![]() |
কয় প্যাঁচ দিয়ে তুলসী মালা পরতে হয় |
কয় প্যাঁচ দিয়ে তুলসী মালা পরতে হয়?
এইবার তুলসী মালা কেন তিন প্যাঁচ দিয়ে গলায় ধারণ করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা করা যাক!
শাস্ত্র-সম্মতভাবে গলায় তিন প্যাঁচ দিয়েই তুলসী মালা ধারণ করা কর্তব্য, কারণ স্মৃতিশাস্ত্রে তিন প্যাঁচ দিয়ে তুলসীমালা ধারণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন প্যাঁচ দিয়ে তুলসী মালা ধারণ করার সময় তিনটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়,-
১) আমি নিজেকে উদ্ধার করিব হরিনামের দ্বারা প্রথম প্যাঁচ দিয়ে বলতে হয়।
২) দ্বিতীয় প্যাঁচ দিয়ে বলতে হয়--"আমি আমার পরিবারকে উদ্ধার করিব হরিনামের দ্বারা।"
৩) তৃতীয় প্যাঁচ দিয়ে বলতে হয়, "আমি যাহাকে দেখিব, তাহাকে বলিব হরিনাম, উদ্ধার হইবে সে হরিনামের দ্বারা।"
সম্বন্ধ তত্ত্ব তুলসীমালার প্রথম প্যাঁচে নির্দেশ করে অর্থাৎ "জীবের কৃষ্ণের নিত্য দাস স্বরূপ হয় নিত্য"। কৃষ্ণের সঙ্গে যে আমার নিত্য সম্বন্ধ রয়েছে সেই সম্বন্ধকে স্মরণ করে গভীর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তুলসীমালার দ্বিতীয় প্যাঁচ নির্দেশ করে, "অভিধেয় তত্ত্ব" অর্থাৎ কৃষ্ণের সঙ্গে যে একমাত্র সম্বন্ধ রয়েছে তাকে পাওয়ার একমাত্র উপায় হল "ভক্তি"। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র তাই ভগবদ্ভক্তির পন্থাকে "অভিধেয়" বলে বর্ণনা করা হয়েছে! তাই এই তুলসীর দ্বিতীয় প্যাঁচ দিয়ে আমি যেন সেই ভক্তি লাভ করতে পারি।
প্রয়োজন তত্ত্ব তুলসীমালার তৃতীয় প্যাঁচ নির্দেশ করে"। সমস্ত জীবের একমাত্র প্রয়োজন হল "কৃষ্ণপ্রেম" লাভ করা!
তুলসী মালার উপকারিতা ও গুরুত্ব
আধ্যাত্মিক গুরুত্ব: তুলসীকে হিন্দু ধর্মে দেবী লক্ষ্মীর অবতার হিসেবে মানা হয় এবং এটি পরিধান করলে ভগবান বিষ্ণুর আশীর্বাদ লাভ হয়।
জপ মালা হিসেবে ব্যবহার: হরিনাম বা বিষ্ণুর নাম জপ করার জন্য তুলসী মালা বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ১০৮টি মণির মালা দিয়ে জপ করা হয়।
স্বাস্থ্য উপকারিতা: তুলসীর প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাবলী রয়েছে যা শরীরের নেতিবাচক শক্তি দূর করতে সহায়ক।
নেতিবাচক শক্তি প্রতিরোধ: বিশ্বাস করা হয় যে, তুলসী মালা ধারণ করলে খারাপ শক্তি দূর হয় এবং ইতিবাচক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
ভক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধি: তুলসী মালা ব্যবহার করলে একাগ্রতা ও ভক্তি বৃদ্ধি পায়, যা আধ্যাত্মিক উন্নতির সহায়ক।
তুলসী মালা পরিধান করলে অনেক আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উপকার পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী, তুলসী দেবী ভগবান বিষ্ণুর অত্যন্ত প্রিয় এবং তাঁর মালা পরিধান করলে বিভিন্ন সুফল পাওয়া যায়। নিচে কিছু প্রধান উপকারিতা উল্লেখ করা হলো—
আধ্যাত্মিক উপকারিতা:
পবিত্রতা বৃদ্ধি: তুলসী মালা পরিধান করলে মানসিক ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা বৃদ্ধি পায়।
নেতিবাচক শক্তি দূরীকরণ: তুলসী মালা পরলে নেগেটিভ এনার্জি দূর হয় এবং আশীর্বাদ লাভ হয়।
ভক্তির বৃদ্ধি: এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি ও সমর্পণকে দৃঢ় করে।
গণেশ, লক্ষ্মী ও নারায়ণের কৃপা: তুলসী মালা ধারীরা দেবতাদের আশীর্বাদ লাভ করে।
মন্ত্র জপের শক্তি বৃদ্ধি: তুলসী মালা দিয়ে মন্ত্র জপ করলে তা দ্রুত ফল দেয় এবং জপের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
শারীরিক উপকারিতা:
শান্তি ও মানসিক প্রশান্তি: এটি দেহ ও মনের প্রশান্তি দেয় এবং স্ট্রেস কমায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: তুলসী নিজেই ঔষধি গুণসম্পন্ন, তাই তুলসী মালার সংস্পর্শ দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: তুলসী মালা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বায়ু দূষণ প্রতিরোধ: তুলসী গাছ বায়ু বিশুদ্ধ করে, তাই তুলসীর সংস্পর্শ থাকা স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয়।
বিশেষ কিছু বিধি:
তুলসী মালা ধারণ করার আগে শুদ্ধ থাকা উচিত এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এটি ব্যবহার করতে হয়। গো-মূত্র, গঙ্গাজল বা বিশুদ্ধ জলে মালা ধুয়ে নিতে হয়।
তুলসী মালা পরিধান অবস্থায় তামাকজাত দ্রব্য বা আমিষ খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
তুলসী মালা পরিধান করলে মিথ্যা কথা বলা যায় কি?
হিন্দু ঐতিহ্যে তুলসী (পবিত্র তুলসী) মালা পরা পবিত্র বলে বিবেচিত হয়, যা প্রায়শই ভক্তি, পবিত্রতা এবং সুরক্ষার প্রতীক। তবে, কেবল তুলসী মালা পরা কাউকে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখে না। এটি সত্য এবং ধার্মিকতাকে সমর্থন করার জন্য একটি স্মারক হিসাবে কাজ করে বলে বিশ্বাস করা হয়, তবে একজন ব্যক্তির কর্ম এখনও তার নিজস্ব ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে। আপনি যদি আধ্যাত্মিক বা কর্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে তুলসী মালা পরা অবস্থায় মিথ্যা বলাকে অসম্মানজনক হিসাবে দেখা যেতে পারে বা নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বলতে গেলে, মালা নিজেই নিজের কর্মের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ রাখে না।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য তুলসী মালা গলায় দেওয়া কেন প্রয়োজন: তুলসী মালা (তুলসী কাঠ বা পুঁতি দিয়ে তৈরি জপমালা) হিন্দুদের কাছে গভীর আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে। এখানে কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়:
১. ভগবান বিষ্ণু এবং কৃষ্ণের সাথে পবিত্র সংযোগ
তুলসী (পবিত্র তুলসী) কে দেবী তুলসীর রূপে ভগবান বিষ্ণুর স্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিষ্ণু, কৃষ্ণ এবং রামের ভক্তরা ভক্তি এবং আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তুলসী মালা পরিধান করেন।
২. আধ্যাত্মিক উপকারিতা
তুলসী মালা ব্যবহার করে মন্ত্র বা হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করলে আধ্যাত্মিক অগ্রগতি বৃদ্ধি পায় বলে বিশ্বাস করা হয়.বলা হয় এটি মন ও শরীরকে পবিত্র করে, পরিধানকারীকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে আসে।
৩. প্রতিরক্ষামূলক এবং নিরাময়কারী বৈশিষ্ট্য
তুলসী তার ঔষধি গুণাবলীর জন্য পরিচিত এবং নেতিবাচক শক্তি থেকে রক্ষা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।তুলসী মালা পরা শান্তি, সুস্বাস্থ্য এবং রোগ থেকে সুরক্ষা নিয়ে আসে বলে মনে করা হয়।
৪. ভক্তি ও সরলতার প্রতীক
অনেক হিন্দু সাধু ও ভক্তরা ঈশ্বরের প্রতি ত্যাগ ও আত্মসমর্পণের প্রতীক হিসেবে তুলসীমালা পরিধান করেন। এটি পবিত্রতা এবং সুশৃঙ্খল আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতীক।
৫. ধ্যান ও জপ বৃদ্ধি করে
ধ্যানের সময় তুলসীমালা ব্যবহার করলে একাগ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রার্থনার শক্তি বৃদ্ধি পায়। বলা হয় যে তুলসীমালা জপ করলে আশীর্বাদ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়।
৬. ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ
পদ্ম পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে তুলসীর উপকারিতার প্রশংসা করা হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, তুলসী মালা পরিধান করা হিন্দুদের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয় যা আপনার মন ও দেহের পাশাপাশি আপনার ইহকাল ও পরকালের জন্য এটি পরিধান করা আবশ্যক তাই আমরা সকল সনাতনিরা তুলসী মালা পরিধান করে সংসার জীবনের পাশাপাশি সদা সত্য পথে পরিচালিত হয়ে নামে কৃষ্ণ নামে নিজের জীবন বিসর্জন দিব।
Comments
Post a Comment