ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি
বিশ্বাস করা হয় হিন্দুদের পঞ্জিকা অনুসারে, ভাদ্রপদ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে (চন্দ্রের অস্তমিত পর্যায়) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়েছিলেন এই পৃথিবীতে। বিশ্বব্যাপী ভক্তরা তাই এই দিনটিকেই জন্মাষ্টমী হিসেবে পালন করেন।
পঞ্জিকা গ্রেগরিয়ান অনুসারে, এটি সাধারণত প্রতি বছর আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর এই দিনটি। ঐতিহ্যগতভাবে তাঁর আবির্ভাবের তারিখ প্রায় ৩২২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, যা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে দ্বাপর যুগের সূচনা হয়েছিল যে সময় ঠিক সেই সময়।
![]() |
জন্মাষ্টমী |
শুভ জন্মাষ্টমী পালন করা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি বা জন্মতিথি হল শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী। এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়।
শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে উদযাপিত হয়, যা সাধারণত অগাস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে পড়ে। এই দিনটিতে ভক্তরা উপবাস, কীর্তন, ভগবদ্গীতা পাঠ এবং শ্রীকৃষ্ণের লীলার স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি বা জন্মাষ্টমী প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয়। তবে এটি শ্রীকৃষ্ণের কততম আবির্ভাব তিথি? তা নির্ধারণ করা জটিল, কারণ এটি নির্ভর করে ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক গণনার উপর।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব প্রায় ৫,২৫১ বছর আগে দ্বাপর যুগে হয়েছিল। যদি ধরে নেওয়া হয় যে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৩,২২৭ বা তার কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাহলে ২০২৫ সালে এটি আনুমানিক ৫,২৫১তম জন্মাষ্টমী হতে পারে।
তবে বিভিন্ন মত অনুযায়ী গণনায় সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে। আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো পঞ্জিকা অনুযায়ী জানতে চান, তবে বিস্তারিত জ্যোতিষ গণনা করা লাগবে।
পৃথিবীতে শ্রীকৃষ্ণ আসার (আবির্ভাব) মূল কারণ কি?
ভগবদ্গীতা এবং শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত ভগবান কৃষ্ণের পৃথিবীতে অবতরণ করার প্রধান কারণ ছিল ধর্ম (ধার্মিকতা) পুনরুদ্ধার করা এবং মন্দকে পরাজিত করার সময় ভক্তদের রক্ষা করা।
ভগবদ্গীতায় (অধ্যায় ৪, শ্লোক ৭-৮), ভগবান কৃষ্ণ ঘোষণা করেছেন:
"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির ভবতি ভারত,
অভ্যুত্থানম্ অধর্মস্য তদাত্মানম্ সর্বজমি অহম্।
পরিত্রানয় সাধুনাম বিনাশয় চ দুষ্কৃতম্,
ধর্ম-সংস্থাপনার্থয় সম্ভাবামি যুগে যুগে।"
অর্থ: যখনই অধর্ম (অধর্ম) বৃদ্ধি পায় এবং ধার্মিকতা (ধর্ম) হ্রাস পায় তখনই কৃষ্ণ অবতারণা করেন। তিনি পুণ্যবান (সাধুদের) রক্ষা করেন, মন্দকে (দুষ্কৃতম) ধ্বংস করেন এবং ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যুগের পর যুগ (যুগের পর যুগ) পৃথিবীতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য আবির্ভূত হন।
তাঁর অবতারণার অন্যান্য কারণ: দানব রাজা কংসকে বধ করা - কৃষ্ণ দেবকী এবং বাসুদেবের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু যশোদা এবং নন্দ তাঁকে লালন-পালন করেছিলেন। তাঁর কাকা কংস, একজন দুষ্ট শাসক, মানুষকে অত্যাচার করছিলেন এবং কৃষ্ণ তাকে পরাজিত করার জন্য নিয়তিবদ্ধ ছিলেন।
মানবজাতিকে ভগবদগীতা প্রদান করা - কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের কাছে তাঁর ঐশ্বরিক উপদেশ কর্তব্য, ভক্তি এবং ধার্মিকতার উপর কালজয়ী জ্ঞান প্রদান করে।
ঐশ্বরিক প্রেম এবং ভক্তির উদাহরণ স্থাপন করা - তাঁর লীলা (ঐশ্বরিক নাটক), বিশেষ করে গোপী এবং রাধার সাথে, বিশুদ্ধ প্রেম এবং ভক্তির চিত্র তুলে ধরে।
পাণ্ডবদের উন্নীত করা এবং মহাভারতে অধর্মকে পরাজিত করা - কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, ধর্মকে অধর্মের উপর জয়লাভ নিশ্চিত করেছিলেন।
কৃষ্ণের অবতার কেবল মন্দকে ধ্বংস করার বিষয়ে নয় বরং মানবজাতিকে প্রেম, কর্তব্য, ভক্তি এবং ধার্মিকতা শেখানোর বিষয়েও ছিল, তাঁর উপস্থিতিকে চিরন্তন এবং সর্বদা প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল।
গীতার কথামতো ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো—ভগবদ্ প্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ জীবাত্মার ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদ্গুণ সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুর্গুণ-দুরাচারের অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়াকে বোঝানো হয়। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, সর্বভূতের ঈশ্বর, শাসক, স্রষ্টা, নিয়ামক হয়েও নিজ (স্বাভাবিক) অনির্বচনীয়া মায়াশক্তিতে আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি (দেহ ধারণ করি)।
শ্রীকৃষ্ণের প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। ঋদ্বেদে একাধিকবার শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণকে দেবকীপুত্র বলা হয়। মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভাগবত এবং বৈষ্ণবকাব্যে যে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তাঁর আবির্ভাব দ্বাপর যুগে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতার নাম বসুদেব ও মাতার নাম দেবকী। তিনি পিতামাতার অষ্টম পুত্র। রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসের কারাগারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। পিতা বসুদেব শ্রীকৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই দৈবসহায়তায় কারাগার থেকে তাঁকে গোকুলে যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল গভীর অন্ধকার। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বসুদেব দেখলেন শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণবৃক্ষ নারায়ণ তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণ তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিয়েছিলেন পুতনাবধ, দামবন্ধন লীলা, কলীয়দমন, গোর্বধন ধারণ প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। নিপীড়িত মানুষ মুক্তির আশায় কানুর তথা কৃষ্ণের অনুসারী হয়ে ওঠে এবং ক্রমান্বয়ে কংসবধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। অবশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংস রাজাকে বধ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা ও জন্মাষ্টমীর তাৎপর্য হলো:
১. বসুদেব যখন ছোট শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন তখন কারাগার আপনি আপনিই খুলে গেল। প্রহরীসহ সব জীব সেই রাতে ছিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যমুনা বসুদেবকে যাওয়ার পথ করে দিল। প্রকৃতপক্ষে এই সবকিছুই কৃষ্ণের ভগবত্তা। [শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে (২/৮৮] ২.
২। ‘ভগবানের সমস্ত অবতারেরা হচ্ছেন পুরুষাবতারদের অংশ অথবা কলা। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান।’
৩. মহাপ্রভু বলেছেন, ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। শাস্ত্রে তাঁর ছয়টি রূপের কথা বলা হয়েছে—ব্রহ্মত্ব, ভগবত্ত্ব, জ্ঞেয়, আস্বাদ্য ঐশ্বর্য, মাধুর্য।
৪.ঋষি কৃষ্ণের নাম উল্লেখ আছে ঋদ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১১৬ এবং ১১৭ সুক্তে ।
৫. শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর প্রাচীনতম নিদর্শন মথুরার চিত্তশালার খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের অর্ধভগ্ন প্রস্তর ফলকে দেখতে পাওয়া যায়।
৬. ‘মহাভারত তন্ত্র ধার' বলা হয়েছে বিষ্ণুপুরাণে শ্রীকৃষ্ণকে।পৃথিবীর জীব-জগত কুলের পরম পিতা,আত্মা,পরমসত্তা হলেন ঋগবান শ্রীকৃষ্ণ,তিনি আবার এই সমগ্র মহাবিশ্বের জগত গুরু। এই মহাবিশ্বের কুলুষিত পরিবেশ ও কুলুষিত বন্ধন দুর করে জীবের মধ্যে আত্মার বন্ধন সুদৃঢ় করেছেন তিনি। তিনি অর্জুনের মাধ্যমে গীতার আঠারোটি অধ্যায়ে জাগতিক জ্ঞান, ধ্যান, কর্ম, বিভূতি, ভক্তি, মুক্তি, মোহ, যশ, খ্যাতি আর অর্থ-বিত্তের মায়াজাল, অন্যায়, অসত্য, পাপ আত্মঅহংকার, মোক্ষ লাভ প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। তিনি সব প্রাণীর মধ্যের তমগুণের প্রভাব অর্থাৎ অসৎ কার্য পরিহার করে ন্যায়-সত্য প্রতিষ্ঠা করেন। জীবকুলে তিনি সত্যের বাণী স্থাপন করেছেন। ন্যায়ের পক্ষে ভগবদ্ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে জীবশিক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্ম করেন। আগামী দিনে সত্যের পথে চলার মতো আলোকবর্তিকারূপে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
মন্তব্যঃভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি একটি মঙ্গলময় তিথি। এই তিথিতে যেহেতু ভগবান ধরাধমে আবির্ভাব হয়েছিল তাই এটিকে সনাতন ধর্মীরা সৌভাগ্যের দিন হিসেবে মান্য করে থাকেন। তাই আজকের এই পুণ্য তিথিতে ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিন্ময় সম্পর্ক গড়ে উঠুক, এটাই হোক আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।
Comments
Post a Comment