কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও ব্রত বিধি
কামদা একাদশী (Kamada Ekadashi) হল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পালনীয় বিশেষ এক একাদশী ব্রত, যা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে পালন করা হয়ে থাকে। আবার এটি বাংলা বছরের প্রথম একাদশী হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে পড়ে বাংলা মাসের চৈত্র মাসে হয়ে থাকে।
কামদা একাদশীর মাহাত্ম্য:
"কামদা" শব্দের সঠিক অর্থ হলো ইচ্ছা পূরণকারী। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালনের মাধ্যমে ভক্তের সকল ধরনের সদ্ইচ্ছা পূর্ণ হয় ও তার সাথে সকল পাপ খয়প্রাপ্ত হতে থাকে।
এটি সব একাদশীর মধ্যে বিশেষ, কারণ এটি যে কোনও ধরণের পাপ মোচনে এবং বিশেষ করে কামনা পূরণে সক্ষম বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।
![]() |
কামদা একাদশী |
- কামদা একাদশীর মাহাত্ম্য
- ২০২৫ সালে কামদা একাদশীর তারিখ:
- কামদা একাদশীর ব্রতের মন্ত্র
- কামদা একাদশীর উপাখ্যান
- কামদা একাদশীর করণীয় ও বর্জনীয়
ব্রতের নিয়মাবলি:
ব্রতের আগের দিন (দশমী) পবিত্রতা রক্ষা করে নিরামিষ আহার গ্রহণ করতে হয়। একাদশীতে উপবাস, ভগবান বিষ্ণুর পূজা, উপচারে অর্ঘ্য প্রদান, হরিনাম সংকীর্তন করা হয়। দ্বাদশীতে ব্রত সমাপন করে দান-ধ্যান ও অন্নগ্রহণ করা হয়।
২০২৫ সালে কামদা একাদশীর তারিখ:
২০২৫ সালে, কামদা একাদশী পালিত হবে মঙ্গলবার, ৮ই এপ্রিল। একাদশী তিথি শুরু হবে ৭ই এপ্রিল রাত ৮:০০ টায় এবং শেষ হবে ৮ই এপ্রিল রাত ৯:১২ টায়। ব্রত সমাপন (পরণা) করা হবে ৯ই এপ্রিল সকাল ৬:০১ থেকে ৮:৩৪ এর মধ্যে।
কামদা একাদশীর ব্রতের মন্ত্র:
"ওঁ কামদে সর্বকামাং মে দেহি স্বপ্নে চ সিদ্ধিদে।
ত্বৎপ্রসাদাৎ হরেঃ পাদে স্থানং মে ভবতু নিত্যম্।।"
কামদা একাদশীর উপাখ্যান:
পুরাণ অনুযায়ী, একবার একটি রাজ্যে একটি গান্ধর্ব ও অপ্সরা দম্পতি ছিল। গান্ধর্ব অনিচ্ছাকৃতভাবে এক রাজদণ্ড ভঙ্গ করেছিল এবং তার ফলে তাকে অভিশাপ দিয়ে রাক্ষসে পরিণত করা হয়। পরে তার স্ত্রী এক ঋষির কাছ থেকে কামদা একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য জানতে পেরে সেই ব্রত পালন করেন এবং তার স্বামী অভিশাপ মুক্ত হয়।এখন এই কামদা একাদশীর উপোখ্যানের বিস্তারিত গল্প জানবো নিম্নের প্রবন্ধ থেকে.....বাংলা চৈতি মাসের শুক্লপক্ষের তিথিতে কামদা/কাদশী ব্রত পালিত হয় বলে উল্লেখ পাওয়া যায় বরাহ্ পুরাণে। মহারাজ যুধিষ্ঠির বাসুদেব কে বললেন, আপনি দয়া করে আমার কাছে চৈতি মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীর গুণ মহিমা আমার কাছে কীর্তন করুন। শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, হে মহারাজ! এই কামদা একাদশী ব্রত সম্পর্কে এক বিচিত্র কাহিনী বর্ণনা করছি যা আপনি একান্ত মনে শ্রবণ করুন। বশিষ্ঠ মহারাজ দিলীপের কৌতুহল নিবারণের জন্য পূর্বে এই একই ব্রতকথা কীর্তন করেছিলেন মহর্ষি।ঋষি বলিষ্ঠ বললেন, হে মহারাজ!! চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম ‘কামদা'। এই তিথি পাপনাশক ও পুণ্যদায়িনী। পূর্বকালে মনোরম নাগপুরে স্বর্ণনির্মিত গৃহে বিষধর নাগেরা বাস করত। তাদের রাজা ছিলেন পুন্ডরীক। গন্ধর্ব, কিন্নর ও অস্পরাদের দ্বারা তিনি সেবিত হতেন। গন্ধর্ব স্বামী-স্ত্রী রূপে ঐশ্বর্য্যপূর্ণ এক গৃহে পরমসুখে দিনযাপন করত সেই পুরীমধ্যে অস্পরা শ্রেষ্ঠ ললিতা ও ললিত নামে । একদিন পুন্ডরীকের রাজসভায় ললিত একা গান করছিল। এমন সময় ললিতার কথা তার মনে পড়ল। ফলে সঙ্গীতের স্বর-লয়-তাল-মানের বিপর্যয় ঘটল। কর্কটক নামে এক নাগ ললিতের মনোভাব বুঝতে পারল। গানের ছন্দভঙ্গের ব্যাপারটি সে পুন্ডরীক রাজার কাছে জানাল। তা শুনে সর্পরাজ ক্রোধভরে কামাতুর ললিতকে-‘রে দুর্মতি! তুমি এবার রাক্ষসের পরিণত হবে বলে অভিশাপ দান করল। এই অভিশাপের ফলে ললিত রাক্ষস সম একটি দানবের আকৃতি নিলেন এই রাক্ষসের আকৃতি এমন ছিল যেন তার হাত দশ হাত বিস্তৃত, মুখ ছিল পর্বতের গুহার মতো, আগুনের ন্যায় ছিল তার প্রজ্জ্বলিত চোখদ্বয়, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার শরীর ছিল আট যোজন বিস্তৃত।ললিতের এরকম ভয়ঙ্কর রাক্ষস শরীর দেখে ললিতা মহাদুঃখে চিন্তায় ব্যাকুল হলেন। স্বেচ্ছাচারী রাক্ষস ললিত দুর্গম বনে ভ্রমণ করতে লাগল। ললিতা কিন্তু তার সঙ্গ ত্যাগ করল না। ললিত নির্দয়ভাবে মানুষ ভক্ষণ করত। এই পাপের ফলে তার মনে বিন্দুমাত্র শান্তি ছিল না। পতির সেই দুরাবস্থা দেখে ব্যথিত চিত্তে রোদন করতে করতে ললিতা গভীর বনে প্রবেশ করল। একদিন ললিতা বিন্ধ্যপর্বতে উপস্থিত হল। বিন্ধ্যপর্বতে তিনি ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম দর্শনপুর্বক মুনির কাছে হাজির হলেন। তারপর তিনি ঋষির চরণে প্রণাম পূর্বক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তখন মুনিবর জানতে চাইলেল,হে সুন্দরী! তুমি কে ও তুমি কাহার কন্যা কেনই বা এখানে এই গভীর জঙ্গলে এসেছো?তা আমাকে সত্য করিয়া বল। মনের উত্তরে ললিতা বলিল, হে প্রভু! বীরধন্যা গন্ধর্বের কন্যা আমি।ললিতা আমার নাম ।এমন কোন উপায় জানবার জন্য এখানে এসেছি যাতে আমার পতির পিশাচত্ব দূর হয় । তখন ঋষি বললেন- চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের কামদা নামে যে একাদশী আছে, তুমি সেই ব্রত যথাবিধি পালন কর। এই ব্রতের পূণ্যফল তোমার স্বামীকে অর্পণ করলে তৎক্ষণাৎ তার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হবে। বশিষ্ঠ ঋষি বললেন-হে মহারাজ দিলীপ, মনের কথা শুনে আনন্দ সহকারে ললিতা কামদা একাদশী পালন করতে শুরু করলেন। ললিতা তার প্রিয়তম স্বামীর উদ্ধারের জন্য ব্রাহ্মণ ও বাসুদেবের সামনে কামদা একাদশী ব্রত পালন করার জন্য যে সমস্ত ফল আমি লাভ করেছি তার সমগ্র আমার স্বামীর উদ্দেশ্যে অর্পণ করলাম। এই পুণ্যের প্রভাবে তাঁর পিশাচত্ব দূর হোক।'এই কথা উচ্চারণ মাত্রই ললিত শাপ মুক্ত হয়ে দিব্য দেহ প্রাপ্ত হল। পুনরায় গন্ধর্ব দেহ লাভ করে ললিতার সাথে সে মিলিত হল। তারা বিমানে করে গন্ধর্বলোকে গমন করল। হে মহারাজ দিলীপ এই ব্রত যত্নসহকারে সকলেরই পালন করা কর্তব্য। এই ব্রত ব্রহ্মহত্যা পাপবিনাশক এবং পিশাচত্ব মোচনকারী। এই ব্রত কথা শ্রদ্ধাপূর্বক পাঠ ও শ্রবণে বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়।
কামদা একাদশীর করণীয় ও বর্জনীয়:
হিন্দু ধর্মে কামদা একাদশী একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রত, যা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে পালিত হয়। এই ব্রত পালনে মোক্ষ লাভ ও ইহকালীন কামনা পূরণ হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। নিচে ব্রতের বিস্তারিত বিধি দেওয়া হলো:
১. ব্রতের প্রস্তুতি
একাদশীর একদিন আগে (দশমী তিথিতে) সন্ধ্যায় স্নান করে সংযম পালন করুন।
রাতভর ব্রহ্মচর্য মেনে চলুন এবং একাদশীর দিন ভোরবেলা স্নান করে পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করুন।
২. ব্রতের দিনের নিয়ম
সূর্যোদয়ের আগে উঠে "কামদা একাদশী ব্রত" পালনের সংকল্প করুন।
স্নানান্তে বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি/প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে ধূপ, দীপ, ফুল, তুলসীপত্র ও ফল নিবেদন করুন।
মহামন্ত্র "ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়" জপ করুন অথবা বিষ্ণু সহস্রনাম পাঠ করুন।
দিনভর উপবাস রাখুন (জল, ফল বা দুধ গ্রহণ করা যায়, কিন্তু শস্য বা লবণ বর্জন করুন)।
৩. পূজা ও কাহিনী শ্রবণ
ব্রতকথা (কামদা একাদশীর পৌরাণিক কাহিনী) পাঠ বা শ্রবণ করুন।bসন্ধ্যায় আরতি করে ভক্তিসহকারে প্রসাদ বিতরণ করুন। রাতে ভগবানের নাম জপ করে শয়ন করুন।
৪. দ্বাদশীর দিন পারণ
পরদিন (দ্বাদশী) সূর্যোদয়ের পর ব্রাহ্মণ বা গরিবদের অন্নদান করে উপবাস ভঙ্গ করুন। সম্ভব হলে তুলসী গাছ রোপণ বা দান করুন।
একাদশী ব্রতে কিছু নিয়ম-কানুন ও বর্জনীয় কাজ আছে, যা শাস্ত্রসম্মতভাবে মানা উচিত। একাদশী পালনকারীরা সাধারণত আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে কঠোর ব্রত পালন করেন। নিচে একাদশীতে বর্জনীয় জিনিস ও আচরণগুলো তুলে ধরা হলো:
খাদ্য সংক্রান্ত বর্জনীয়তা:
অন্ন ও শস্য – চাল, গম, ডাল ইত্যাদি শস্যজাত খাবার একাদশীতে সম্পূর্ণভাবে বর্জনীয়।
মসুর ডাল ও বেসন – এগুলোও ত্যাগ করতে বলা হয়।
পেঁয়াজ ও রসুন – তামসিক ও রজসিক খাদ্য, যা একাদশীতে পরিহারযোগ্য।
মাংস, মাছ, ডিম, মদ্যপান – সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
পাকা কলা ও গুড় – কিছু মতে এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত, যদিও মতভেদ আছে।
অতিভোজন – একাদশীর ব্রতে কম আহার বা উপবাস করা উচিত।
চরিত্র ও আচরণ সংক্রান্ত বর্জনীয়তা:
1.ক্রোধ, হিংসা, পরনিন্দা – মানসিক শুদ্ধতার জন্য এসব ত্যাগ করা উচিত।
2,মিথ্যা বলা ও প্রতারণা করা – পাপ বৃদ্ধি করে বলে মনে করা হয়।
3,শারীরিক মিলন – এই দিনে ব্রহ্মচর্য পালন করা শ্রেয়।
4.অবসাদ, অলসতা ও সময় নষ্ট করা – একাদশী ব্রতের উদ্দেশ্য আত্মনিয়ন্ত্রণ, তাই এই আচরণ পরিত্যাজ্য।
আধুনিক জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে:
অপ্রয়োজনীয় মোবাইল ব্যবহার, গসিপিং, সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট – এগুলোও এক ধরনের মানসিক বিভ্রান্তি, যা এই দিনে বর্জনীয়।
বিশেষ তাৎপর্য
এই ব্রত পালনে পাপমুক্তি, মানসিক শান্তি ও ইষ্টকামনা পূরণ হয় বলে শ্রীমদ্ভাগবত ও পুরাণে উল্লেখ রয়েছে। এটি শ্রীবিষ্ণুর প্রতি ভক্তি বৃদ্ধিরও একটি উত্তম উপায়।
শরীর ও মনকে বিশুদ্ধ করে ভগবান বিষ্ণুর ভক্তি ও স্মরণে ডুবে থাকা। তাই সবকিছু যা আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত বা বিচলিত করে, তা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
tag:
কামদা একাদশী মাহাত্ম্য,কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য,কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য 2026,কামদা একাদশী,কামদা একাদশীর মাহাত্ম্য,একাদশী মাহাত্ম্য,কামদা একাদশী ব্রত,কামদা একাদশী 2026,কামদা একাদশী ব্রত কথা মাহাত্ম্য ২০২৫ ,কামদা একাদশী মাহাত্ম্য 2025,কামদা একাদশী ব্রত কথা,কামদা একাদশী তিথি,কামদা একাদশী ২০২৫ ,কামদা একাদশী ২০২৫ ,কামদা একাদশী মাহাত্ম্য 2026,কামদা একাদশীর গুরুত্ব,কামদা একাদশী ব্রত কথা পারণ সময় ২০২৫
Comments
Post a Comment