মূর্তি পূজা কেন করা হয়
মূর্তি পূজা হল হিন্দু ধর্মের একটি প্রচলিত উপাসনার পদ্ধতি, যেখানে ভক্তরা ঈশ্বর বা দেবদেবীর একটি মূর্তিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে পূজা করে। এই মূর্তিকে কেন্দ্র করে ভক্তি, প্রার্থনা ও উপাসনা করা হয়, যা ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা ও আত্মনিবেদনের প্রকাশ। অতএব, "মূর্তি পূজা" (Murti Puja) বলতে বোঝানো হয় কোনো দেব-দেবীর প্রতিমা বা মূর্তিকে উপাসনার মাধ্যমে শ্রদ্ধা ও ভক্তি জ্ঞাপন করাকে। মূর্তিপূজাকে হিন্দু ধর্মের একটি প্রচলিত আচার বলা যায়, যেখানে ভগবানকে মূর্তির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হয় এবং সেই সকল দেবদেবী/মূর্তির আরাধনা করা হয়।ঈশ্বরকে অনুভব করার সহজ মাধ্যম
মানুষের পক্ষে নিরাকার, নিরগুণ, অদৃশ্য ঈশ্বরকে ধ্যান করা কঠিন। তাই ঈশ্বরের একটি দৃশ্যমান রূপ কল্পনা করা হয়। সেই রূপই মূর্তি।
মূর্তি পূজা কী?
"মূর্তি" শব্দের অর্থ হলো কোনো কিছুর দৃশ্যমান রূপ বা অবয়ব। "পূজা" মানে হলো উপাসনা বা শ্রদ্ধা নিবেদন। তাই মূর্তি পূজা মানে কোনো দেবতা বা ঈশ্বরের একটি দৃশ্যমান রূপ বা প্রতিমার মাধ্যমে তাঁকে উপাসনা করা। কিছু প্রচলিত মূর্তি পূজার উদাহরণ:
দুর্গা পূজা – দেবী দুর্গার মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয়।
কালী পূজা
লক্ষ্মী পূজা
গণেশ পূজা
শিবরাত্রি তে শিবলিঙ্গ পূজা
কেন মূর্তি পূজা করা হয়?
১. ঈশ্বরকে উপলব্ধির জন্য দৃশ্যমান মাধ্যম: ঈশ্বর নিরাকার (আকারহীন) হলেও, সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই নিরাকার সত্তাকে উপলব্ধি করা কঠিন। তাই ঈশ্বরের কোনো রূপ বা মূর্তির মাধ্যমে তাঁকে অনুভব ও উপাসনা করা সহজ হয়।
২. ভক্তির বিকাশ: মূর্তি ভক্তদের মনোসংযোগের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। চোখের সামনে দেবতার রূপ দেখে ভক্তি আরও গভীর হয়।
৩. প্রতীকী ব্যাখ্যা: মূর্তিগুলি আসলে ঈশ্বরের গুণ, শক্তি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ, দুর্গার দশটি হাত দশটি শক্তির প্রতীক, গণেশের বড় কান শোনার ক্ষমতার প্রতীক, ইত্যাদি।
৪. আত্মিক সংযোগের সহজ উপায়: মূর্তি পূজা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর সেই মূর্তিতে বাস করেন ভক্তের আহ্বানে। তাই সেই মূর্তি হয়ে ওঠে ঈশ্বরের এক পবিত্র রূপ, যা পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ ঘটায়।
মূর্তি পূজার ইতিহাস
অতি প্রাচীন এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। নিচে বিভিন্ন সভ্যতা ও ধর্মে মূর্তি পূজার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
প্রাচীন সভ্যতায় মূর্তি পূজা
সিন্ধু সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০–১৩০০) সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পূজার জন্য ব্যবহৃত মূর্তি ও প্রতিমার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।"পশুপতি শিব" নামে একটি মূর্তি পাওয়া গেছে, যা সম্ভবত প্রোটো-শিবের রূপ।মাতৃদেবী (Mother Goddess) এর মূর্তিও পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা করা হয় যে সিন্ধু সভ্যতায় দেবী উপাসনা প্রচলিত ছিল।
মেসোপটেমিয়া (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০–৫০০) সুমেরীয়, আক্কাদীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় দেবদেবীর মূর্তি পূজা হতো।মন্দিরে দেবতার মূর্তি স্থাপন করে নিয়মিত পূজা-অর্চনা করা হতো।
প্রাচীন মিশর (খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০–৩০) মিশরীয়রা ফারাওদের এবং বিভিন্ন দেবদেবীর (রা, ওসাইরিস, আইসিস, হোরাস ইত্যাদি) মূর্তি তৈরি করত। মূর্তিগুলোকে দেবতার জীবন্ত প্রকাশ বলে মনে করা হতো এবং নিয়মিত পূজা-উৎসর্গ করা হতো।
গ্রিক ও রোমান সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৮০০–খ্রিস্টীয় ৪০০)গ্রিকরা জিউস, অ্যাথেনা, অ্যাপোলো প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করত।
রোমানরা গ্রিক দেবতাদের নিজস্ব নামে পূজা করত (যেমন: জিউস = জুপিটার, আফ্রোদিতি = ভেনাস)। মন্দিরে মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হতো এবং উৎসর্গ ও বলিদানের প্রথা ছিল।
ভারতীয় ধর্মে মূর্তি পূজা
হিন্দুধর্ম
বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০–৫০০) প্রকৃতি দেবতাদের (ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ) পূজা করা হতো, কিন্তু মূর্তি পূজার সরাসরি প্রমাণ কম। পরবর্তীতে পুরাণ ও তন্ত্রযুগে (খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকে) মূর্তি পূজার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, গণেশ প্রভৃতি দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ ও পূজা হিন্দুধর্মের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আগম শাস্ত্রে মূর্তি নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার বিস্তারিত নিয়ম বর্ণিত আছে।
মূর্তি পূজার রহস্য ?
মূর্তি পূজার রহস্য একটি গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বিষয়, যা শুধুমাত্র বাহ্যিক রীতিনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়—এটি একজন ভক্তের অভ্যন্তরীণ ঈশ্বর উপলব্ধি করার একটি উপায়ও। এই রহস্যকে বোঝার জন্য আমাদের কয়েকটি স্তরে ভাবতে হয়—আধ্যাত্মিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও দর্শনীয়। গভীর দৃষ্টিতে:
১. আকারে নিরাকারের অনুভব:
ঈশ্বর বা ব্রহ্ম নিরাকার ও অনন্ত। কিন্তু মানব মনের সীমাবদ্ধতায় আমরা সহজে নিরাকারকে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই ভক্তরা ঈশ্বরের এক নির্দিষ্ট রূপ কল্পনা করেন এবং মূর্তি সেই রূপেরই বাহ্যিক প্রকাশ। যেমন: যেমন একজন শিশু তার মাকে চেনে একটি নির্দিষ্ট মুখের মাধ্যমে, ঈশ্বরকে বোঝার জন্যও এক রূপ দরকার হয়।
২. ভক্তির মনঃসংযোগের কেন্দ্র:
মূর্তি একটি প্রতীক। এটি মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করে। মন্ত্র, ধূপ, আলো, ফুল যেমন: মন যেমন ছেলেমানুষের মতো ছুটে বেড়ায়, মূর্তি সেই মনকে কেন্দ্রীভূত করার একটি মাধ্যম।
৩. দেবতা ও মূর্তির পার্থক্য:
হিন্দু দর্শনে বলা হয়—মূর্তি দেবতা নয়, বরং সেই দেবতাকে আহ্বান করে, তাঁর শক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসবাস করায়। যখন প্রতিমা বানানো হয়, তখন ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ করা হয়, যা আসলে শক্তির আহ্বান। যেমন: মোবাইল ফোনে যেমন সিগনাল না থাকলে কিছুই কাজ করে না, তেমন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা না করলে সেটি কেবল পাথর বা মাটি মাত্র।
৪. মানবিক সম্পর্ক গঠন:
মানুষের অনুভবের দিক থেকে, ঈশ্বরকে পিতা, মাতা, বন্ধু বা সন্তানরূপে কল্পনা করে মূর্তির সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। ভক্তি হল সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক গড়তে মূর্তির প্রয়োজন পড়ে।
৫. প্রতীক ও শক্তির কেন্দ্র:
মূর্তি নিজে শক্তি নয়, কিন্তু তা একটি শক্তির কেন্দ্রবিন্দু—যেমন ধ্যানের সময় কোনও প্রতীক আমাদের মনের শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। যেমন: একটি পতাকা কেবল কাপড় নয়—তা জাতির শক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
আসুন মূর্তি পূজার রহস্যের একটি গল্প শুনি,,,,,,,,,
মানুষের মন চঞ্চল। স্বভাবতই আমাদের মন নানা পার্থিব আকাঙ্ক্ষা ও কামনায় পূর্ণ থাকে। তাই চাইলেই আমরা সেই কামনা-বাসনা থেকে দূরে সরে যেতে পারি না।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ছাত্র চায় শ্রেণিতে প্রথম হতে, এবং এই লক্ষ্যে সে মা সরস্বতীর আরাধনা করে থাকে।এই চঞ্চল মনকে স্থির ও সংযত করার একটি উপায় হলো সগুণ সৃষ্টিকর্তার বিভিন্ন রূপের ভাবনা বা চর্চা। আমরা যেন ভুলে না যাই—ঈশ্বরের বিশালতা ও অসীমতাকে আমাদের সীমাবদ্ধ চিন্তা দিয়ে পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তবে ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণকে উপলব্ধি করতে করতে একদিন হয়তো সেই পরম সত্যকে স্পর্শ করা সম্ভব হতে পারে। এগুলো ঈশ্বরের গুণের রূপক বা প্রতীক। যেমন গণিতে কোনো সমাধানে আমরা ‘x’ ধরি—x নিজে কিছু নয়, কিন্তু তাতেই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। আবার জ্যামিতিতে “বিন্দু” দিয়ে শুরু করি, যার দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ নেই—কিন্তু তার অবস্থান আছে, যা নিছক কল্পনা। অথচ সেই কল্পনাতেই আমরা মহাসাগরের গভীরতা থেকে পাহাড়ের উচ্চতা মাপতে পারি। তেমনই, ভূগোল পড়তে গিয়ে গ্লোব বা ম্যাপ ব্যবহার করি। আমরা জানি, গ্লোব বা ম্যাপ আসল পৃথিবী নয়। তবু সেগুলো থেকেই আমরা পৃথিবীকে চেনা শুরু করি। একইভাবে, মূর্তি বা প্রতিমাও ঈশ্বর নন—তাঁদের প্রতীক বা রূপক। এই প্রতিমা আমাদের চঞ্চল মনকে একাগ্র করতে সাহায্য করে এবং ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণাবলি সম্পর্কে আমাদের ভাবতে শেখায়। এই ভাবনা থেকেই আমরা ঈশ্বরের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারি। এটা হলো কল্পনার ভিত্তিতে সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের ধর্মে ঈশ্বরের দুই রূপের উপাসনার বিধান আছে—নিরাকার ও সাকার। নিরাকার ঈশ্বরের কোনো প্রতিমা নেই, থাকাও সম্ভব নয়। যারা নিরাকার ঈশ্বরের ধ্যান করেন, তাঁরা "নিরাকারবাদী"। যারা সাকার ঈশ্বরের উপাসনা করেন, তাঁরা "সাকারবাদী"। শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় বলা হয়েছে—নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসকও ঈশ্বরলাভ করেন। তবে নিরাকার ঈশ্বরের উপর মনোযোগ স্থাপন করা অনেক বেশি কঠিন। তুলনায়, সাকার ঈশ্বরের রূপে মন স্থির করা সহজ।এই কারণেই সাকার ভগবানের প্রতিমা আমাদের জন্য সহায়ক। এগুলোর মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কার্যক্ষমতার সঙ্গে পরিচিত হই।–এছাড়া আমাদের পরম ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণ ও কার্যকারীতা সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এই মূর্তিগুলি, ২ টি উদাহরণ দিচ্ছি ভালো ভাবে বোঝার জন্য –
(১)ব্রহ্মার ৪টি মাথা কেনো? কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নাম ব্রহ্মা অর্থ্যাৎ স্রস্টা যিনি ৪টি বেদের উৎপত্তি করেছিলেন , এই গুনটিকে বোঝাবার জন্য ব্রহ্মার মূর্তিতে ৪টি মস্তক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্বে বেদ একটি ছিল পরে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ঐ একটি বেদ কে, তাদের গুরুত্ব অনুসারে বিভাজন করে ৪টি বেদে পরিণত করেন, তাই বর্তমান ধারণা অনুসারে ব্রহ্মার ৪টি মাথা দেওয়া হয়েছে, আমরা তো সবাই জানি চারটি মাথা কিন্তু সত্য নয়,তাহলে চারটি মাতা হলো চারটি বেদের ব্যাপারে ব্যাখ্যা।
(২)শিবের তিনটি চোখ কেনো? কারন ভগবানের ঐ গুণবাচক নামে ৩টি গুণ-সত্ত্বঃ,রজোঃ ও তমোঃ প্রকাশ হচ্ছে। এর জন্য শিবের মূর্তিতে তিনটি চোখ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভগবান তো নির্গুণা, এখানে তিনটি চোখ এটাই বোঝাচ্ছে পরম ভগবান এই গোটা জগৎ কে এই ত্রিগুণ-সত্ত্বঃ, রজোঃ ও তমোঃ দিয়ে নির্মান করেছেন। অর্থ্যাৎ এই সম্পূর্ণ জগৎ তিনটি গুনের আধারে তৈরী।
তবে কি হিন্দুরা পৌত্তলিক ?
অন্যান্য ধর্মের অনেক অনুসারী হিন্দুদের মূর্তি-পূজাকে ভুলভাবে বোঝেন এবং একে "পৌত্তলিকতা" বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু তারা যদি প্রকৃত অর্থটি বুঝতেন, তাহলে হয়তো এমন ভুল ধারণা করতেন না। আমি আগেই বলেছি— সনাতন ধর্মে দেবতা অনেক, কিন্তু ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। এই সকল দেবতা হলেন সেই এক ও অখণ্ড ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের প্রতিফলন। আর মূর্তি বা প্রতিমা সেই গুণগুলির প্রতীক, রূপকল্প বা চিহ্ন মাত্র। আসলে, শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, প্রায় সব ধর্মেই পবিত্র প্রতীক বা রূপকল্প রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে ঈশ্বর বা তাঁর গুণাবলির স্মরণ করা হয়।উদাহরণস্বরূপ: খ্রিস্টানদের গির্জায় দেখা যায় মাতা মেরীর মূর্তি কিংবা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর প্রতিমা। তারা সেই প্রতিমার সামনে প্রার্থনা করেন, চোখে জল আনেন, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন—তাঁদের ঈশ্বরকে। মুসলিম ভাই-বোনেরা কাবাশরীফের কালো পাথরকে চুম্বন করেন, কিংবা আল্লাহর নাম লেখা কোনো কাগজকে অত্যন্ত সম্মান করেন, সেটিকে মাটিতে ফেলেন না বা অপমান করেন না। তাহলে কি ঐ পাথর বা কাগজই ঈশ্বর? না, অবশ্যই নয়। তবুও তা তাঁদের কাছে পবিত্র—কারণ তা ঈশ্বরের নামের, স্মৃতির, ভালবাসার প্রতীক। ঠিক তেমনি, হিন্দুরাও যখন কোনো মূর্তির সামনে প্রার্থনা করেন, সেটা আসলে সেই নিরাকার ঈশ্বরের কোনো গুণের স্মরণ। মূর্তি শুধু উপাসনার একটি মাধ্যম, লক্ষ্য নয়। অনেকে শূন্যপানে চেয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করেন। তাহলে কি সেই শূন্যেই ঈশ্বরের বসবাস? নিশ্চয়ই নয়। এটা কেবল একজন মানুষের বিশ্বাস ও অনুভবের জায়গা। সনাতন ধর্মে বিশ্বাস, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তাই যে কেউ, যেকোনো জায়গায়, যেকোনো রূপে ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারেন। মূর্তি সেই অনুভবের একটি সুনির্দিষ্ট ও দৃশ্যমান রূপ—একটি প্রতীক যার সাহায্যে চঞ্চল মনকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। যদি ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই কোনো না কোনো প্রতীকের মাধ্যমে ঈশ্বরচিন্তা করা হয়। সেই অর্থে, সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে রূপকল্পের মাধ্যমে উপাসনা করে থাকেন। সুতরাং, হিন্দুদের মূর্তি-পূজাকে “পৌত্তলিকতা” বলে সমালোচনা করার আগে, সেই দর্শন ও ব্যাখ্যাটি বোঝা জরুরি। কারণ, উপাসনার মাধ্যম আলাদা হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য এক—ঈশ্বরের প্রতি প্রেম, শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণ।
মূর্তি পূজার পেছনের ভাবনা:
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় যে ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং নিরাকার, কিন্তু ভক্তরা ঈশ্বরের সঙ্গে একটি দৃশ্যমান সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নিরাকারকে আকারে কল্পনা করেন। সেই কারণে মূর্তি হচ্ছে একপ্রকার মাধ্যম—ভক্তের মনঃসংযোগ, আরাধনা ও প্রেম নিবেদনের একটি রূপ।
বিতর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি:
কিছু ধর্ম বা মতবাদে মূর্তি পূজাকে 'মুর্তিপূজা' বা 'মূর্তিরূপে ঈশ্বরকে সীমাবদ্ধ করা' বলে সমালোচনা করা হয়।
আবার অনেক দর্শনে (যেমন: আদ্বৈত বেদান্ত) বলা হয়, মূর্তি কেবল একটি প্রতীক—যার মাধ্যমে ভক্ত ঈশ্বরের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন।
শেষ কথা:
মূর্তি পূজার রহস্য আসলে আত্মিক সংযোগের রহস্য। এটি বাহ্যিক পূজা নয়, বরং এক গভীর অভ্যন্তরীণ ভক্তিপথ—যেখানে নিরাকারকে অনুভব করার জন্য আকারকে ব্যবহার করা হয়।
Comments
Post a Comment