ত্রিসন্ধ্যা কাকে বলে? সময় ও তাৎপর্য | Hindu Rituals Explained
ত্রিসন্ধ্যা কর্ম:সঠিক সময়ে ঈশ্বর স্মরণের গুরুত্ব ও পদ্ধতি বা জীবনের প্রতিদিনের এক গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুশীলন।
ত্রিসন্ধ্যা কাকে বলে?
ত্রিসন্ধ্যা কর্ম বলতে মূলত সূর্যোদয়ের পূর্বে, মধ্যাহ্নে এবং সূর্যাস্তের পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরের নামজপ ও ধ্যানকে বোঝানো হয়। এই তিনটি সময়কে যথাক্রমে বলা হয় প্রাতঃসন্ধ্যা, মধ্যাহ্নসন্ধ্যা এবং সায়ংসন্ধ্যা। প্রত্যেক সন্ধ্যার সময় গায়ত্রী মন্ত্র ধ্যান ও জপের ধরণ এবং হাতের অবস্থান ভিন্ন হয়ে থাকে।
ত্রিসন্ধ্যার সময়
অনেক সাধক মধ্যরাতেও জপ-ধ্যান করেন বলে জানা যায় (যেমন রামকৃষ্ণ মিশনের ‘ব্রহ্মগায়ত্রী’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে)। সব সময় সূর্যের অবস্থানকে ভিত্তি করে এই ত্রিসন্ধ্যার সময় নির্ধারিত হয়।
![]() |
ত্রিসন্ধ্যার ছবি |
প্রথম সন্ধ্যা (প্রাতঃসন্ধ্যা)
সূর্যোদয়ের অন্তত আধঘণ্টা আগে উঠতে হয়। একে ব্রাহ্ম মুহূর্তে জাগরণ বলা হয়।
উঠেই হাত-মুখ ধুয়ে যারা দীক্ষিত, তারা গুরুর স্মরণ করে তাঁর প্রদত্ত মন্ত্র জপ করবেন।
যারা দীক্ষিত নন, তারা ঈশ্বরের যেকোনো নাম (যেমন রাম, কৃষ্ণ, হরিনাম, ওঁ ইত্যাদি) অন্তত ১০৮ বার জপ করবেন।
এই জপ ও ধ্যান সূর্যোদয়ের পর আধঘণ্টা পর্যন্ত চলতে পারে।
দ্বিতীয় সন্ধ্যা (মধ্যাহ্নসন্ধ্যা)
স্নানের পর দুপুরে বা তার কাছাকাছি সময়ে ঈশ্বরের নাম কমপক্ষে ১০৮ বার জপ করতে হয়।
এটি মধ্যাহ্নে মানসিকভাবে ঈশ্বর স্মরণের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়।
তৃতীয় সন্ধ্যা (সায়ংসন্ধ্যা)
সূর্যাস্তের আধঘণ্টা পরে থেকে শুরু করে শোবার আগে যেকোনো সময়, বিশেষ করে সন্ধ্যা আরতির সময় জপ-ধ্যান করা শ্রেয়।
nb:এখানেও ১০৮ বার বা তার বেশি ঈশ্বরের নাম জপ করা উচিত।
ত্রিসন্ধ্যার তাৎপর্য
সর্বদা নামজপ ও ধ্যানের গুরুত্ব
ত্রিসন্ধ্যা ছাড়াও প্রতিদিনের বিভিন্ন সময়ে যেমন: ঘুম থেকে ওঠার সময়, শোবার সময়, হাঁচি, কাশি বা হাই তোলার সময়, যেকোনো কাজের শুরু ও শেষে, ঈশ্বরের নাম স্মরণ করা উচিত।
শ্রীমদ্ভগবদ গীতার ৮/৫ শ্লোক অনুযায়ী:"মৃত্যুকালে যে ব্যক্তি ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে, সে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে।"
নামজপের উপায়:
দীক্ষিতরা তাদের গুরু-প্রদত্ত ইষ্টমন্ত্র জপ করবেন। অনাদিক্ষিতরাও 'ওঁ','রাম','কৃষ্ণ','হরি','রামকৃষ্ণ','নারায়ণ' ইত্যাদি নামে ঈশ্বরকে ডাকতে পারেন।গায়ত্রী মন্ত্র জানা থাকলে সেটিও জপ করা অত্যন্ত ফলদায়ী।
গায়ত্রী মন্ত্র:
ওঁ ভূঃ ভূবঃ স্বঃ।
তৎ স’বিতুর্ বরণ্যং।
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিও যো নঃ প্রচোदयাত্॥
মন্ত্রার্থ: এই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার ধ্যান করি, যিনি আমাদের বুদ্ধিকে সত্যের পথে পরিচালিত করেন।
পূজার চেয়ে নামজপ বা নাম করা বড় তাঁর চেয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করা আরো বড় সর্বদা জানবেন । তাই ধ্যান জপ, অবশ্যই কর্তব্য। তবে পূজা করা কর্তব্য বিশেষ দিনে । সর্বদা কর্তব্য জপ ধ্যান ।
📖Table of contents
- ত্রিসন্ধ্যা কাকে বলে
- ত্রিসন্ধ্যার সময়
- ত্রিসন্ধ্যার তাৎপর্য
- ত্রিসন্ধ্যা কর্ম সম্পর্কে ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্স ও প্রামাণিক
ত্রিসন্ধ্যা কর্ম সম্পর্কে ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্স ও প্রামাণিক উৎস
বেদ ও উপনিষদে ত্রিসন্ধ্যার উল্লেখ
১. ঋগ্বেদ (৩.৬২.১০) - গায়ত্রী মন্ত্র
Copy
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ
এই মন্ত্রটি ত্রিসন্ধ্যা জপের মূল ভিত্তি। গায়ত্রীকে বেদমাতা বলা হয় এবং তিন সন্ধ্যায় এর জপের নির্দেশ আছে।
২. তৈত্তিরীয় আরণ্যক (২.১১.১)
"ত্রিসন্ধ্যমুপাসীত" - তিন সন্ধ্যায় উপাসনা করবে বলে উল্লেখ আছে।
৩. ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩.১৬.১)
সন্ধ্যা উপাসনাকে ব্রহ্মোপাসনার অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
স্মৃতি গ্রন্থ ও ধর্মশাস্ত্রে প্রমাণ
১. মনুসংহিতা (২.১০১)
"প্রাতঃসন্ধ্যা চ কর্তব্যা সায়ং সন্ধ্যা বিশেষতঃ
মধ্যাহ্নে চৈব কর্তব্যা ত্রিসন্ধ্যা হ্যেষা সনাতনী"
অর্থ: প্রাতঃসন্ধ্যা, মধ্যাহ্ন সন্ধ্যা ও সায়ংসন্ধ্যা - এই ত্রিসন্ধ্যা সনাতন ধর্মের অঙ্গ।
২. পরাশর স্মৃতি (৩.৬)
"ত্রিসন্ধ্যাং যঃ সমারভ্য জপধ্যানপরায়ণঃ
স সর্বপাপবিমুক্তো ব্রহ্মলোকং স গচ্ছতি"
অর্থ: যে ব্যক্তি ত্রিসন্ধ্যায় জপ ও ধ্যানে নিমগ্ন থাকে, সে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়।
৩. বিষ্ণু পুরাণ (৩.৮.১৫)
ত্রিসন্ধ্যায় সূর্যের বিভিন্ন অবস্থান ও তার আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বর্ণনা করা হয়েছে।
গীতা ও ভাগবতে ত্রিসন্ধ্যা
১. ভগবদ গীতা (৬.১৪)
"প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্নিঃসঙ্গঃ সর্বতো মুখঃ
যতেন্দ্রিয়মনোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ"
তাত্পর্য: সন্ধ্যাকালে একাগ্রচিত্তে ধ্যানের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।
২. শ্রীমদ্ভাগবত (১১.২৭.৩৫)
"ত্রিসন্ধ্যং যঃ স্মরেন্নিত্যং ত্র্যম্বকং ত্রিগুণাত্মকম্
স যথা ত্রিগুণৈর্মুক্তো ভবত্যেবং ন সংশয়ঃ"
অর্থ: যে নিত্য ত্রিসন্ধ্যায় ত্র্যম্বক (শিব)কে স্মরণ করে, সে তিন গুণ থেকে মুক্ত হয়।
তন্ত্র ও যোগশাস্ত্রে নির্দেশ
১. মহানির্বাণ তন্ত্র (৫.১-৩)
ত্রিসন্ধ্যায় বিভিন্ন মন্ত্র জপের বিশেষ বিধান দেওয়া হয়েছে।
২. হঠযোগ প্রদীপিকা (২.১১)
"প্রাতঃ মধ্যাহ্ন সায়ং চ ত্রিসন্ধ্যং ধারয়েদ্ধিয়ম"
অর্থ: তিন সন্ধ্যায় ধ্যান করবে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী
১. সময় নির্ধারণ:
প্রাতঃসন্ধ্যা: সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট পূর্ব থেকে (ব্রাহ্মমুহূর্ত)
মধ্যাহ্ন: স্থানীয় সূর্য মধ্যাহ্ন সময়
সায়ংসন্ধ্যা: সূর্যাস্তের পর
২. বৈদিক গণনা অনুযায়ী:
দিনকে ৮ প্রহরে বিভক্ত করে তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম প্রহরে সন্ধ্যা নির্ধারণ
৩. আধুনিক রামকৃষ্ণ মিশনের রীতি:
স্বামী বিবেকানন্দ ত্রিসন্ধ্যা উপাসনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন
সতর্কতা: বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সন্ধ্যা সময়ের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু মূলনীতি একই।
উপসংহার:
ত্রিসন্ধ্যা কর্ম হলো এমন একটি আত্মিক অনুশীলন যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও ঈশ্বরের স্মরণে যুক্ত রাখে। পূজার থেকেও নামজপ এবং ধ্যান অধিক ফলদায়ী।
যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানেই আমরা ঈশ্বরের নাম করতে পারি – হাঁটতে হাঁটতে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে বা বিশ্রামের সময়।
স্মরণ রাখুন – "ঈশ্বরের নামেই রয়েছে মুক্তির পথ"।
Comments
Post a Comment